[ad_1]
আমাদের উপমহাদেশীয় নারীপুরুষের শ্রমবিভাগ খুব পরিষ্কারভাবে দাগ কাটা। এতই পরিষ্কার এখানে কোন ওভারল্যাপ নেই। বহু বহু কাল ধরে চলে আসছে। এপার্ট ফ্রম ইসলাম, একদম ট্র্যাডিশনাল। ঘরের কাজ, রান্না, বাচ্চা পালা মেয়েদের কাজ। অর্থনৈতিক যোগান দেয়া, বাজার সদাই ছেলেদের কাজ। বহু কাল ধরে মেয়েরা তাদের রোল ভালোভাবেই প্লে করে এসেছে, সন্দেহ নাই। সুখ-দুঃখের বহু ইতিহাস পার করে মেয়েরা যখন কর্মক্ষেত্রে ঢোকা শুরু করলো, মাটির উপরে গেঁড়ে থাকা (যার শিকড় ভিতরে বহুদূর বিস্তৃত ছিল অলরেডি) সমস্যাগুলো মাথাচাড়া দেয়া শুরু করল।
বেচারা মেয়েদের মহাজ্বালা। ঘরের কাজ থেকে তো রেহাই নাই, তায় আবার বাহিরটাও সামলাতে হয় দুইহাতে। সুপারওম্যানরাও টায়ার্ড হয় বৈকি। তাই বিজ্ঞাপন-নাটক বহু মিডিয়ার মাধ্যমে ছেলেদের বাসার কাজে সাহায্য করার ইস্যুটাকে সামনে আনার চেষ্টা চলতে লাগলো। সারাদিন বাইরের কাজে ম্যালা হ্যাপা। বাসায় ফিরে কাজ করতে হবে! রাত জাগতে হবে বাচ্চার জন্য! এবসার্ড। তার জন্য তো বাচ্চার মা আছেই। বাসায় আর কি ই বা কাজ থাকে? মেয়েদের অফিসেই বা এমন কি কাজ? সাজুগুজুতেই তো কাজ হাসিল হয়ে যায়। কাজেই বাসার ফেলনা কাজগুলো তোমার জন্যেই যত্নে তুলে রাখলাম।
বাচ্চার কান্নায় বাবা ঘুমাতে পারে না। তার আরামের অবস্থা ষোলআনা। মা ঘরের বাইরে কাজ করুক কি না করুক, বাচ্চার সাথে মাকেই জাগতে হবে। নিউবর্ন বাচ্চা নিয়ে মা একা রাত জেগে শরীরের-মনের ক্লান্তি দূর করার প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছে, পাশের ঘরে বাবার নাক ডাকার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। দৃশ্যপট অতি পরিচিত। বাচ্চাকে তো আর বাবার পক্ষে ব্রেষ্টফিডিং করানো সম্ভব না, বাবার জেগে কাজ কি? বাবা কিন্তু সহজেই সাপোর্ট সিস্টেম হয়ে দাঁড়াতে পারতেন মা’টার পাশে। নিদেনপক্ষে একবার ডায়াপার চেইঞ্জ, মাকে এক গ্লাস পানি আগিয়ে দেয়া, বা বুঝলাম হয়তো কিছুই সম্ভব হলো না, সকালে উঠে একটু মাথায় হাত রাখা “তোমার অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে, না?”। অনেক অনেক বাবার তাও হয়ে উঠে না।
বাচ্চা খায় না? টডলার কথা শুনে না? টেরিবল টু চলে? বাচ্চা সামলাতে পারো না? সারাদিন বাসায় থেকে বাচ্চার অযত্ন!/ অফিসে পড়ে থাকলে বাচ্চা এইরকমই হবে। অন্য সবাই, এমনকি বাবা থেকে শুরু করে, গোটা সমাজটা মায়ের দিকে আঙ্গুল তুলে আছে। করো কি? করটা কি? কেন তোমার বাসা গুছানো না? কেন তুমি ভোরে উঠে পঞ্চব্যঞ্জন রাঁধো না? কেনই বা তুমি ফ্রেশ রাঁধো না? কেন বাসি খাবারে দিন পার করো? কেন দুইটার বেশী আইটেম নাই? কেন দাওয়াতে টেবিল ভরে না? এগুলোতো সব তোমার কাজ ছিল! তোমার লাইফ এখন ইজি, তোমার ওয়াশিং মেশিন আছে, ওভেন আছে। ঢেঁকিতে পার দিতে হয় না, গোবরে ঘর লেপতে হয় না, তাহলে পারো না কেন?
বিদেশে অনেক ভদ্রলোকেরা কাজে হাত লাগান। নিজের ব্রেকফাস্টটা বানিয়ে নিলেন, কালেভদ্রে কিছু রাঁধলেন, কি ডিশটা ধুয়ে দিলেন, কি বাথরুমটা ক্লিন করলেন, কি বাচ্চাই রাখলেন কিছুসময়ই। খুশি হও না কেন মেয়ে? “তোমার কাজ”ই তো করে দিচ্ছে। মেয়ে কিছুতেই ভেবে পায় না, সংসারটা তো দুইজনের হওয়ার কথা ছিল। নিজের কাজ নিজে করাটা মানুষের সার্ভাইভাল ইন্সটিঙ্কটের অংশ। বাচ্চাতো দুইজনেরই। কিন্তু বাবা রাখলে কেমন জানি টার্মটা ফর্মাল “বেবিসিটিং” এর মতো শোনায়। বহুবছর বিদেশে থাকা ভাইদের দেখেছি, ঘরের কাজে ভুলেও হাত লাগান না। সারাদিন “শুধুমাত্র” ঘরে কাজ আর ছোট-বড় বাচ্চা সামলিয়ে টায়ার্ড ভাবিকে নিত্যকার ফিরিস্তি দিতে দিতে চোখের পানি ফেলতে দেখেছি। এদের অনেক বাবা আবার ছেলে সন্তানটিকেও ঘরের কাজের মতো তুচ্ছ কাজে হাত লাগাতে দিতে রাজি নন।
এই প্রজন্মের বিদেশে জন্মানো/বড় হওয়া মেয়েগুলো দেশী ছেলে, অলরেডি দেশে থাকে এমন, বিয়ে করতে একদম ইন্টারেস্টেড না। এদের সোজা হিসাব। সারাজীবন দেশী বাবাকে দেখেছে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে। মা কাজ করতে করতে পিঠ বাঁকা হয়ে গেছে। এই ভুল তারা করতে রাজি না। সিরিয়াসলি বিয়ের যোগ্য মেয়েদের বাবা-মায়েদের অনেকেই এই ইস্যুতে চিন্তিত। জামাই পাবো কই। আবার এমনও আছেন, ছেলের নিজের পছন্দ না থাকাতে, বিয়ে করিয়ে এনেছেন দেশ থেকে। ব্যাস, সব দিক দিয়ে সেইফ। সাত চড়ে রা করবে না। বাবা-মা তো স্বপ্নের দেশে মেয়ে বিয়ে দিতে পেরে খুশী। ভেজাল খাচ্ছে না, ভালো আছে, নাতি-নাতনিদের রঙ্গিন ছবি। এই বেশ। ভালো থাকতে এত কমপ্লেইন করো কেন মেয়ে? এত চাহিদা কিসের তোমার!
যে যেভাবেই বলি, আমরা মেয়েরা ঘরকন্না করতে পছন্দ করি। বাচ্চা সামলাতে মেয়েরা এক পায়ে খাঁড়া। কিন্তু একটা সাপোর্ট সিস্টেম লাগে। দেশে শুধু কাজের লোকের কাজ থেকে সেটা পাওয়া যায় না। বিদেশে তো তাও নেই। এই সাপোর্ট সিস্টেম হতে পারে একমাত্র হাজব্যান্ড। সংসারটা দুইজনের। বলছি না, একদম দাঁড়িপাল্লার নিক্তি ধরে ধরে সব কাজ সমান ভাগে ভাগ করতে হবে। ঘরের কাজে হেল্প করা রসূলের সুন্নাহ্। সেটাকে নিজের কাজ মনে করে করাই যায়। বাচ্চাগুলোকে নিজের মনে করে মা কে একটু পড়াশুনা/কাজের সুযোগ, কিংবা সারাদিন ঘরকন্নার পর দম ফেলতে একটু “মি টাইম” দেয়াই যায়। বা বুঝলাম, একদমই সম্ভব হচ্ছে না কোনদিন, একটু ভালো কথা, এপ্রিসিয়েশন, সমবেদনা জানোনাই যায়। সংসারের কাজকে নিজের কাজ মনে করলেই অনেক সাংসারিক জটিলতা এড়ানো যায়।
একবার একটা প্যারেন্টিং ক্লাসে বলতে শুনছিলাম, প্যারেন্টিং একটা হাসানাহ্ অর্জনের জায়গা। এমন না যে তুমি বেশী, আমি কম করবো। বরং বাবা-মা দুইজনেরই এখানে কমপিট করার করার কথা কে বেশী হাসানাহ্ নেবে। অথচ একতরফা মায়ের কোর্টে বল রেখে, প্যারেন্টিং এর গোটা বিষয়টাকে জটিল করে ফেলা হয়েছে। মায়েরা একটা, দুইটা বাচ্চা পালতেই ক্লান্ত। মাদারহুডকে নিজস্ব ভালোলাগার জায়গা হিসেবে নিতে ভয় পায়। তারউপর এবার এদিক সেদিক সবদিক থেকে আঙ্গুল উঁচানো। শুধু ঘরে, কিংবা ঘরেবাইরে কাজ করে মন পাওয়া যায় না কারুর। মায়েরা সহজেই ক্লান্ত।
মেয়েরা কিন্তু এই সাপোর্ট সিস্টেম ছাড়া ভালো আছে অনেকেই। ভালো থাকা নিজের কাছে- এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে, আমরা আসলে যে যার মতো ভালো থাকার চেষ্টা করি খুব করে, করেই যাই। কোনরকম টিকে থাকা, আর উষ্ণতায় বাঁচা, দুইয়ের মধ্যে যে কি প্রবল ফারাক! আপাতদৃশ্যে অনেক অনেক ফাঁপা জায়গাগুলো ভরাট করে অনায়াসে সংসারকে মায়া দিয়ে ভরিয়ে দেয়া যায়। শ্রমবিভাজন থাকবে না কেন? অবশ্যই থাকবে, নইলে সভ্যতার চাকা এগিয়ে যাবে কিভাবে? কিন্তু একটু ওভারল্যাপ করে নেই। শুধু কায়িক পরিশ্রম না, মানসিক পরিশ্রমও। “তুমি কম- আমি বেশী” এভাবে না ভেবে “আমাদের ছোট তরী” আমরাই তীরে নিয়ে যাবো- এভাবে ভাবলে ক্ষতি কি? ছোট্ট ছোট্ট ছিদ্রগুলো বুজে দিতে এর বেশী লাগে না খুব বেশী।
ডিসক্লেইমারঃ অনেক পরিবারে ব্যাতিক্রম থাকে। ভাইরা অনেকবেশী বাসার কাজে ইনভলবড। বাচ্চাকে অনেক সময় দেন। ওয়াইফের প্রতি কেয়ারিং। তারা এই স্ট্যাটাসেও কোথাও নেই। কারন তারা অলরেডি “উষ্ণতায় বাঁচেন”। সদ্য হাজব্যান্ড মারা যাওয়া একজন ওয়াইফকে বলতে শুনেছি “আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটাকে হারালাম। আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ, সবচাইতে সাপোর্টিভ হাজব্যান্ড, সবচেয়ে ভালো বাবা।” ভাবছিলাম, এই মানুষটা দুনিয়াতেই তার আখিরাতের একটা মূল্যবান সার্টিফিকেট পেয়ে গেছেন। আল্লাহ্র কাছে যেয়ে খুব কষ্ট করতে হবে না তাকে। সব পুরুষরা তাদের নারীদের কাছে এমন ভরসার জায়গা হয়ে থাকুক। সংসারগুলো উষ্ণতায় বাঁচুক।
[ad_2]
Source link