July 25, 2023

দিনলিপি

১০ ই ফেব্রুয়ারী’ ২০১৬

খুব ছোটবেলায় বিটিভিতে “বিশ্বনাটক” বলে একরকম নাটক দেখাত। অনেকটা মঞ্চ নাটকের মতো, স্টেজ সাজিয়ে। অতো ভালো বুঝতাম না কিছুই। তাও বড়দের সাথে বসে দেখতাম। কেন এখনও মনে আছে জানিনা, একবার এরকম একটা নাটকে দেখালো নাটকের পাত্রপাত্রীরা সবাই একটা কামরার ভেতর। সবাই যে যার মতো গল্প করছে, মজা করছে। হঠাত একজনের মনে হলো তারা আসলে সবাই এই ঘরটাতে আটকা পড়েছে। এখান থেকে যে কেউ বের হতে পারছে না, অন্যরা এটা বুঝতেই পারছে না! সেই একজনের মনে হলো তার দম বন্ধ হয়ে আসছে এই বদ্ধ ঘরটাতে। ছটফট করে উঠল সে, তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। প্রানপনে বের হতে চাইছে সে, কিন্তু অন্যরা তাকে আটকে রাখতে চাইছে। বলছে- কেন পাগলামি করছ! এই ঘরের বাইরে আর কিছু নেই, তুমি পারবে না এখান থেকে বের হতে, অসম্ভব! শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিলো আমার আর মনে নেই। সে কি আদৌ সেখান থেকে বের হতে পেরেছিলো কিনা, বা নাটকটাতে আসলেই কি বুঝাতে চেয়েছিলো। ইদানিং মাঝেমাঝেই মনে হয় নাটকটার কথা। আমাদের জীবনটাও মনে হয়ে একরম একটা বদ্ধ ঘরে বন্দী। আমরা যে যার মতো জীবন কাটিয়ে দেই। এই বন্ধ ঘরটার বাইরেও যে একটা উজ্জ্বল দিন থাকতে পারে, খোলা সবুজ মাঠ থাকতে পারে, আমাদের চিন্তাতেও সেটা আসে না। কুপমন্ডুকের মতো জীবন কেটে যায়। নীল আকাশ আর দেখা হয় না।

১১ই ফেব্রুয়ারী’ ২০১৬

আমার শোবার ঘরের দেয়াল ঘড়িটা বন্ধ হয়ে ছিলো বেশ কিছুদিন। আলসেমি করে ব্যাটারী পালটানো হচ্ছিলো না। সময় দেখতে ফোন কিংবা অন্য ঘরের ঘড়ি দেখতে হচ্ছিলো। তারপরও অভ্যাসবশতঃ বারবার চোখ চলে যাচ্ছিলো বন্ধ ঘড়িটার দিকে। এটাই হয়ত স্বাভাবিক রিফেক্স। প্রতিবারি অন্য ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে এবার বন্ধ ঘড়িটার দিকে তাকাতে ভুলে গেলাম।একসময় মনে হলো অনেক হয়েছে, এইবার ব্যাটারী লাগানো যাক।আবার শুরু হলো ঘড়ির চাকা ঘোরা। অদ্ভুত ব্যাপার হলো এখনো আমি এই ঘড়িটা বাদ দিয়ে অন্য ঘড়িগুলোতেই সময় দেখতে থাকলাম। এমনকি অন্য ঘরে যেয়ে হলেও! অথচ ঘাড় ঘুরালেই যেখানে সময় দেখা যায়। আমাদের অন্যদের সাথে সম্পর্কগুলোও বোধহয় এরকম। প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিনত হওয়া জীবনযাপন প্রনালী। মাঝেমাঝেই সুতো কেটে যায়। আবার হয়তো জোড়াও লাগে। কিন্তু জোড়া লাগানো গেঁড়োটা ঠিকই বেখাপ্পা দেখায় বাইরে থেকে। কেউ বোঝে, কেউ বোঝে না।

১২ই ফেব্রুয়ারী’ ২০১৬

সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। যতটা দ্রুত না ভাবছি, তার চাইতেও অনেক দ্রুত। এইত কয়দিন আগের কথা, বাসা থেকে নিয়ে গিয়ে স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে আসল ছোট্ট আমাকে। পিঠে ঝুলানো ব্যাগের সাথে একটা গোলাপী টিফিন বক্স আর একটা নীল রঙয়ের পানির ফ্লাস্ক। কত রঙ-বেরঙের স্বপ্ন চোখে। এখনো এত পরিস্কার মনে আছে! ক্যালাডাইস্কোপের ভেতর দিয়ে দেখা জীবন। সেই স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, চাকরি পার হয়ে সংসার। এখন আমি আমার মেয়েকে কোলে নিয়ে চিন্তা করি, আমার মা ও আমার মতোই ভাবত বোধহয়, যখন আমি কোলে ছিলাম। তার মা ও হয়ত তাকে কোলে নিয়ে। খুব বেশী আগের কথা তো নয়! জীবন গড়িয়ে যাচ্ছে, চাকার উপর ভর দিয়ে।অনিশ্চয়তার সাথে নিশ্চিন্ত ভবিষ্যতের দিকে…

১৪ই ফেব্রুয়ারী’ ২০১৬

ঢাকায় আমাদের বাসার বিল্ডিংয়ের সবকয়টা ফ্ল্যাটের ডোরনবে কি যেন একটা সমস্যা আছে। কথা নাই বার্তা নাই, হঠাৎ করে আটকে যায়। না পারা যায় ভিতর থেকে খুলতে, না বাইরে থেকে। খুব সম্ভবত যে ডেভেলপারদের দেয়া হয়েছিল, তাদের কাজের ফলাফল। অবধারিতভাবেই তালাচাবি ওয়ালার ফোন নাম্বার সবার সেইভ করা। ঘনঘনই ডাক পড়ে তার। গতবার আমি যখন ঢাকায় গেলাম, বাসার বাইরে থেকে ফিরে আমি আম্মুর বিছানায় সটান উঠে পড়েছি। আম্মুর সাথে কথা বলতে বলতে আমি ঘুম। আমার বোন দিলো দরজা বন্ধ করে ভিতর থেকে। আর দরজা খুলে না। ভিতরে আমরা তিনজন আটকা পড়েছি। রাত বাজে ১০ টা। তালা চাবিওয়ালার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম, কুম্ভকর্নের ঘুম। সেই ঘুম ভাঙ্গলো ঘন্টা দুইয়েক পর। ততক্ষনে চাবিওয়ালা প্রচন্ড শব্দে গোটা বিল্ডিং খবর করে দরজার লক খুলেছে। কিছুদিন আগে মন্ট্রিয়ালে এই ঘটনার পুনরাবৃতি। বাইরে থেকে বাসায় ফিরে আর ঢুকতে পারছি না। দরজা লক হয়ে গেছে। ল্যান্ডলেডিকে খবর দেয়া হলো। সিঁড়িতে অপেক্ষা করছি। এরমধ্যে আমার মেয়ে তারস্বরে চিৎকার শুরু করেছে। বয়স তার এক মাস তখন। এখানে তো আর দরজা আটকে গেলে কারো বাসায় যেয়ে বসার উপায় নেই। মেয়ে কোলে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তার কান্না থামানোর চেষ্টা করছি। যাইহোক শেষ পর্যন্ত লক ভেঙ্গে দরজা খুলে নতুন লক লাগানো হলো। বাইরে চাবি হাতে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিলো ঘরের ভেতরেই অপেক্ষা করে আছে উষ্ণতা আর স্বাচ্ছন্দ্য। অথচ দরজা খুলতে না পারলে ঢোকার উপায় নেই। কতকত দরজা এরকম রোজ আটকে যায় আমাদের জীবনে। সম্পর্কের, সম্ভবনার, আশার। আমাদের হাতে চাবি, তালার কম্বিনেশন জানা। তারপরও কোথায় যেনো লক আটকে যাওয়া। বন্ধ দরজার সামনে চাবি হাতে দাঁড়িয়ে আমাদের নিরব প্রতীক্ষা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Copyright © Afifa Riahana
Designed by Thinkpool
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram