এখন ডিসেম্বর মাস দেখেই বোধহয়, দুই বছর আগের কথা খুব মনে হয়। দুই বছর আগের ডিসেম্বরে প্রথম বেবি হলো। বিদেশ বিভুঁইয়ে, আত্মীয়-স্বজন বিহীন। আম্মু ভিসা পায় নি। আমি মোটামুটি সাহসী মহিলা। খালি ভয় পাচ্ছিলাম, জ্যাস্টেশনাল ডায়াবেটিসের জন্য সি-সেকশন লাগলে কি করবো! কাটাছেঁড়াতে আমার বেজায় ভয়। আলহামদুলিল্লাহ, এরকম কিছু লাগে নি। খালি কারসীট নিয়ে হসপিটালে গেছি, চারদিন পর বেবি নিয়ে খালি বাসায় এসেছি। হসপিটাল থেকে টিপস দিলো কিভাবে বেবির, নিজের টেইক কেয়ার করতে হয়। বাসায় নার্স এসে দেখিয়ে গেলো কিভাবে গোসল করাতে হয়। ব্যাস, আমি আর মেয়ের বাবা মিলে এক মাস চোখের পলকে পার করে দিলাম (সময় যে কোন দিক দিয়ে গেছে, টের পাইনি)। তখন মনট্রিয়ালে এসেছি বেশীদিন হয়নি। কিন্তু এখানকার স্বল্পপরিচিত লোকজন যেরকম হেল্প করলো, সবসময় মনে থাকবে। সময় লাগলো নিজে পুরোপুরি হিল হতে, সময় লাগলো ব্রেস্টফিড করানো শিখতে, সময় লাগলো পোষ্টপার্টেম ডিপ্রেশন থেকে বের হতে। আল্লাহ সহজ করেছেন। একা হাতে বাচ্চা পালতে যেয়ে অনেক সময় মনে হয়েছে, একটু রেস্ট নিতে পারতাম! একটু রাতে ঘুমাতে পারতাম! একটু খাবারটা কেউ রান্না করে দিতো! কিন্তু আল্টিমেটলি দিন পার হয়ে গেছে। একা হাতে বাচ্চা পালা কিছুটা কষ্টকর, কিন্তু অসম্ভব না। আমার কাছে উলটা কিছুকিছু ক্ষেত্রে ব্লেসিংস মনে হয়েছে। বাচ্চার নানী-দাদী বা কাছের কেউ থাকলে হেল্প হয় বটে, কিন্তু উপদেশের ঠেলায় প্রান ওষ্ঠাগত হয় (নতুন মায়েদের নানান রকম গল্প শুনি)। এইসময়টায় মায়েদের শরীর-মন দুইটাই এত বেশী নরম থাকে, লোকজনের অতি ভালো কথাতেও মনটা ভেঙ্গে যায়। আমাদের দেশী লোকজনের মধ্যে মনে হয় এই সমস্যা প্রকট, আমরা নানান জটিল উপদেশ, পরামর্শে সিদ্ধহস্ত। আর মুখ থেকে তীরের মতো ক্রমাগত মন্তব্য তো চলতেই থাকে। আমাদের আশেপাশে যারা নতুন মা হচ্ছেন বা হয়েছেন, তাদের ব্যাপারে খুব বেসিক জিনিস যদি আমরা মাথায় রাখতে পারি, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তাদের মাতৃত্বের শুরুটা সহজ করে তুলতে পারি।
- একজন মা’কে বলুন, তুমি চমৎকার একজন মা। বাহ্, তুমি সবকিছু খুব সুন্দর করে করতে পারছ! এই সামান্য কথা যে একজন মা’কে কতখানি ইন্সপায়ার করতে পারে, চিন্তার বাইরে!
- নতুন বাচ্চা ডাকছেড়ে কাঁদছে? কাঁদবেই তো। কান্নাই তো তার একমাত্র ভাষা। মা’কে বলতে যাবেন না- নিশ্চয়ই দুধ পাচ্ছে না। পেট ভরছে না। তুমি বোধহয় ঠিকমতো খাওয়াতে পারছো না।– মা টা এমনিতেই তার সবটুকু দিতে যেয়ে শ্রান্ত। এই ধরনের কথাগুলো মা’কে ভেঙ্গে ফেলে। বরং পারলে তাকে প্র্যাকটিক্যাল টিপস দেন। আমি আমার বাচ্চাকে এভাবে খাইয়েছিলাম, তুমিও পারলে ট্রাই করতে পারো।
- বাচ্চা এত শুকনা? ফর্মূলা দাও না কেন!- এই ধরনের কথা বলার আগে দুইবার ভাবুন। কারন মায়ের মাধ্যমে বাচ্চা আল্লাহর কাছ থেকে রিযিক নিয়ে আসে। বাচ্চার ওয়েট আর নাম্বার অফ ওয়েট ডায়াপার যদি ঠিক থাকে, স্পেশালি ডাক্তার যদি না সাজেষ্ট করে, আমরা বাইরের মানুষরা ফর্মূলা সাজেস্ট করার কেউ না।
- কেমন মা তুমি বাচ্চার কান্না থামাতে পারো না!- এগেইন, নিউবর্নের একমাত্র ভাষা কান্না। মায়ের যেমন বাচ্চার সাথে এডজাস্ট করতে টাইম লাগে, নিউবর্নেরও নতুন পরিবেশের সাথে এডজাষ্ট করতে টাইম লাগে। আপনি যদি আশেপাশে থেকে থাকেন, কিছু সময় বাচ্চাটাকে আপনিও কোলে নিয়ে আরাম দিতে পারেন। বাচ্চা কাঁদতে থাকলে অন্যদের কেমন লাগে জানিনা, মায়ের যে অসম্ভব খারাপ লাগে, বলাই বাহুল্য। কিন্তু দিনে-রাতে বারবার দুধ খাওয়ানো, রাতের পর রাত জাগা- এগুলা এমনিতেই মা’টাকে কাহিল করে ফেলে। তারপর এগুলা কথা বলে আমরা মা’টাকে আরো কাহিল করে না ফেলি! মা’টাকে বাথরুমে যাওয়ার, শান্তিমতো খাওয়ার টাইম দেই।
- আমরা কি বাচ্চা পালি নাই? তিনটা চারটা বাচ্চা একসাথে পেলেছি।– দাঁড়ান, প্লিজ। আল্লাহ কাউকে সাধ্যের অতিরিক্ত চাপিয়ে দেন নাই। আপনার সামর্থ্য ছিলো, আপনাকে দিয়েছেন। যার সামর্থ্য নাই, তাকে একটা দিয়েই খুশি রেখেছেন। আসুন, আমরাও খুশি থাকি।
- আমরা এইভাবে এইভাবে বাচ্চা বড় করেছি (পরামর্শ না ক্রিটিসাইজিং টোন), তুমি কেন এভাবে কর?- প্রত্যেক মায়ের প্যারেন্টিং স্টাইল ডিফরেন্ট। একমাত্র মা’ই ভালো জানে, কোনটা তার বাচ্চার জন্য ভালো। আমাদের কাছে অন্যটা ভালো মনে হতেই পারে। যদি মনে হয়, তাকে সাহস দিয়ে কথা বলুন। সাজেস্ট করুন। কিন্তু ক্রিটিসাইজ না।
- নতুন মা’কে বিশ্রাম নিতে দিন। ঘরের কাজে সাহায্য করুন। একটা শরীর চিরে একটা মানব শিশুর জন্ম দেয়া কোন সহজ কাজ নয়। আল্লাহ তাকে এই কাজে এসাইন করেছেন, তার মানে এই না, সন্তান জন্ম দেয়ার পরপরই সে সব কাজের জন্য প্রিপেয়ার্ড হয়ে যাবে। শরীরের সাথে সাথে মনটাকেও হিল হতে সময় দিন।
- নতুন মা’টিকে তার প্রাইভেসী বজায় রাখতে সাহায্য করুন। যদি বাড়ীর মানুষ হোন, তাহলে ব্রেস্টফিডিংয়ের সময় তার রুমটি ছেড়ে দিন। কারন স্বাচ্ছন্দ্য খুব জরুরী একটা বিষয় দুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে। যদি দরজা ভেড়ানো থাকে, নক না করে ঢুকবেন না (যদিও এটা সবার বেলায় প্রযোজ্য)। যদি অতিথি হোন, ব্রেস্টফিডিংয়ের সময় সম্ভব হলে, ওই ঘর ছেড়ে আসুন। না হলে ঘুরে বসুন।
- বাচ্চার বাবা বাচ্চার কাজে এনগেইজ হবে, এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। দেখ, বাবাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছে- এইটা বলার আগে ভেবে দেখি, মা’টা নিজের শরীরের ভিতর বাচ্চাকে বড় করেছে, জন্মের পর দুধ খাওয়াচ্ছে, রাতের পর রাত জাগছে- এইগুলা যেমন আপনার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে, তেমনি বাচ্চার ডায়াপার বাবা বদলাচ্ছে, মা’কে ব্রেস্টফিডিং এর আগে একগ্লাস পানি এসে দিচ্ছে- এটা যদি অস্বাভাবিক মনে হয়, তাহলে বলতে হবে, প্যারেন্টিং যে বাবা-মা দুইজনের দায়িত্ব, সেটাই আমরা বুঝি নি এখনো।
নতুন মা’কে তার ভালোর জন্য উপদেশ/ পরামর্শ দিতে চান? সবার আগে ভরসার কথা বলেন। সে এখন না পারলেও খুব শিরগিরি যে পারবে, ইনশাআল্লাহ, সেই কথাটা আগে শোনান। অমুক/তমুকের সাথে কম্পেয়ার না করে, সে যে ইউনিক সেটাতে ফোকাস করুন। মা’টার মনের যত্ন নিন। তাকে আপনার দু’আ এ রাখুন। সেও আপনার জন্য মন ভরে দু’আ করবে।
#মাতৃত্ব