প্রেগন্যান্সি ব্যাপারটাকে আমাদের দেশে খুব সহজাত একটা জিনিস বলেই ধরে নেওয়া হয়। জেনারেশন ধরে আমরা দেখে আসছি, বিয়ের পর একটা মেয়ে প্রেগন্যান্ট হয়, বাচ্চার জন্ম দেয়। এখনকার সময়ে এসে অনেক রকম জটিলতা চোখে পড়ে। আগেও যে ছিলো না, তা না। কিন্তু এখন অনেক রকম জটিলতাই অনেক বেশী। প্রেগন্যান্সিকে এত স্বাভাবিক একটা বিষয় বলে ধরে নেই দেখেই, জীবনের এত ইম্পর্টেন্ট একটা সময়ের জন্য প্রস্তুতি নেয়া হয়ে উঠে না আমাদের। অথচ সুস্থ মা মানেই যে সুস্থ বাচ্চা, বাচ্চার সুস্থতার প্রায় সম্পূর্নটাই নির্ভর করে মায়ের ভালো থাকার উপর।
বাচ্চার জন্মের অনেক আগে থেকে শুরু করা উচিত এর প্রিপারেশন। আমাদের দেশী মেয়েরা এমনিতেও অনেক দিক থেকে অনেক দূর্বল হয়। প্রয়োজনীয় ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, মিনারলস, আয়রনের অভাব তো থাকেই, অনেকে রক্তশূন্যতায় ভোগেন। ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ কিংবা এক্টিভিটির অভাব থেকেই যায়। প্রেগন্যান্সিতে কি ধরনের সমস্যা হতে পারে, সেগুলো ট্যাকেল করার উপায় কি, অনেক জানেনই না সেই সমস্যাগুলোতে পড়ার আগ পর্যন্ত। অথচ কনসিভ করার আগে এই ব্যাপারগুলোতে মনযোগী হওয়া অনেক বেশী দরকার।
নিউট্রিশন
আমাদের দেশে অনেক মেয়েই ছোট থেকেই অপুষ্টিতে ভোগেন। আন্ডারওয়েট থাকেন অথবা ওভারওয়েট থাকেন। দুইটাই সুস্থ প্রগন্যান্সির জন্য সহায়ক না। ব্যালান্সড বি এম আই বজায় রাখাটা (স্কোর ১৯-২৫) যে কারো জন্য অত্যাবশ্যক, প্রেগন্যান্সির জন্য তো বটেই। আমাদের দেশে আমরা ভাত-রুটি জাতীয় শর্করা বেশী খাই, আবার শাক-সবজি আমিষ জাতীয় খাবার খাওয়া হওয়া হয় কম। অথচ একটা আদর্শ মিলে থাকা উচিত অর্ধেক প্লেট সবজি, সালাদ, বাকি অর্ধেক প্লেট আমিষ আর শর্করা।
ভিটামিনস
কনসিভ করার প্লান করার সময় থেকেই নানা রকম ভিটামিনের ঘাটতি মেটানোর জন্য মাল্টিভিটামিন খাওয়া শুরু করা উচিত। অন্তত ছয় মাস আগ থেকে। প্রেগন্যান্সির জন্য স্পেশাল প্রি-ন্যাটাল মাল্টিভিটামিন পাওয়া যায়, যাতে A-Z পর্যন্ত সব রকমের ভিটামিন, ফলিক এসিড একসাথে থাকে। আগ থেকেই যদি এর ঘাটতি মিটিয়ে নেয়া যায়, তাহলে প্রেগন্যান্সিতে আপনি সুবিধাজনক অবস্থাতেই থাকবেন।
ফিটনেস
শরীরের সুস্থতা বজায় রাখার জন্য সবারই কিছু না কিছু এক্সারসাইজ করা উচিত। নিয়মিত হাঁটা, হালকা ব্যায়াম যেগুলো বাসায় বসেই করা যায়- সবসময় করা উচিত। এগুলো শুধু যে শরীর-মন ভালো রাখে তা না, শরীরের জড়তা দূর করে, ফ্লেক্সিবেলিটি বাড়ায়। আগে থেকে এক্সারসাইজ করা তো উচিতই, প্রেগন্যান্ট অবস্থায়ও সে অভ্যাস চালু রাখা উচিত। ট্রাইমিস্টার ভেদে এক্সারসাইজের ধরন আলাদা হবে।
পুরোনো অসুখ
অনেকের অনেক ধরনের ক্রনিক ডিজিজ থাকে, যেমন ব্যাক পেইন, থাইরয়েডের সমস্যা, হেমরয়েডস, হাইপার টেনশন, টাইপ-টু ডায়াবেটিস, পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (পিওসিএস), এজমা এগুলোর ব্যাপারে আগ থেকে যত্নবান হতে হবে। পুরোপুরি কিউর না হলেও যাতে নিয়ন্ত্রনে থাকে।
প্রি-প্রেগন্যান্সি চেক আপ
প্রেগন্যান্সির প্রস্তুতি নেয়ার সাথে সাথে সম্ভব হলে প্রি-প্রেগন্যান্সি চেক আপ করিয়ে নিতে পারেন ডাক্তারের কাছ থেকে। এতে ওবেসিটি, ডিপ্রেসন সহ ক্রনিক ডিজিজগুলো থেকে থাকলে, সেগুলো কিভাবে কন্ট্রোল করা যাবে, সেই সম্পর্কে ধারনা দেবে। এছাড়া ব্লাডটেস্ট করিয়ে নিতে পারেন, যাতে কোন ভ্যাকসিন আগে থেকে দেয়া না থাকলে ধরা পড়ে, সেগুলো প্রেগন্যান্ট হওয়ার আগেই দিয়ে নিতে পারেন।
দাঁতের যত্ন
প্রেগন্যান্সির আগেই দাঁতের চেক-আপ করিয়ে নিন। অনেক ডাক্তার দাঁতের এক্স-রে বা যে কোন ট্রিটমেন্ট, প্রেগন্যান্ট অবস্থায় করাতে প্রেফার করেন না। এই সময় শরীরে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-ডির অভাবে হাড় ও দাঁতের ক্ষয় হতে পারে। ভালো হয় আগে থেকে দাঁত চেক আপ করিয়ে নিলে।
প্রেগন্যান্সি সম্পর্কে জানুন
প্রেগন্যান্সি কোন অসুস্থতা নয়। এটা জীবনের একটা নতুন মাত্রা মাত্র। এই যাত্রা যাতে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে পার করা যায়, সেজন্য আগে থেকে যতদূর সম্ভব জানার চেষ্টা করুন। প্রেগন্যান্সি রিলেটেড বিভিন্ন ওয়েবসাইট আছে, যেমন বেলিবেলি.কম, প্যারেন্টিং.কম -এগুলোতে থেকে প্রচুর ইনফর্মেশন পাবেন প্রেগন্যান্সি রিলেটেড। যত বেশী জানবেন, তত কনফিডেন্স থাকবে আপনার।
মানসিক প্রস্তুতি নিন
শরীরের সাথে সাথে মনে মনেও প্রস্তুতি নেওয়ার ব্যাপার রয়েছে। যারা অলরেডি মনের অসুখে ভুগছেন, যেমনঃ ডিপ্রেসন, তাদের তো বটেই, দিব্যি সুস্থ থাকা মানুষেরও দরকার মানসিক প্রস্তুতি। যে কোন ধরনের মানসিক টানাপোড়েন, যেটা কাছের মানুষগুলোর পরামর্শে ভালো হচ্ছে না, প্রয়োজনবোধে বাইরের সাহায্য নিন। আজকাল আশেপাশে অনেক জায়গা খুঁজে পাবেন, যেখানে কাউন্সিলিং এর সেবা প্রদান করা হয়। মানসিক অস্থিরতায় ডুবে থাকার চাইতে, এইরকম সাহায্য নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ। প্রেগন্যান্সিতে এমনিতেই হরমোনাল ইমব্যালেন্সের জন্য মুড সুইং খুব বেশী পরিমানে হয়। তার উপর বেবি হওয়ার পর বেবি ব্লু, পোস্টপার্টেম ডিপ্রেসনে অনেক মা’ই ভোগেন। আগে থেকেই এইসব বিষয় সম্পর্কে জানা এবং প্রিকশনারী স্টেপস নেওয়াটা জরুরী।
প্রি-ন্যাটাল ক্লাস
বাইরের দেশগুলোতে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় ডেলিভারী ও তার পরবর্তীতে করনীয় অনেক ব্যাপারে প্রি-ন্যাটাল ক্লাসের ব্যবস্থা থাকে। যেখানে, ডেলিভারীর প্রিপারেশন, লেবার সাইন, ব্রেষ্টফিডিং, বাচ্চার টেইক কেয়ার কিভাবে করতে হয়, তার উপর অভিজ্ঞ নার্স ও মিডওয়াইফরা ক্লাস নিয়ে থাকেন। এইসব ক্লাসগুলো প্রচুর তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে থাকে এবং সরাসরি জিজ্ঞাস করে নেওয়ার অপশন থাকে। একজন নতুন কিংবা পুরাতন মায়েদের জন্য এগুলো বেশ উপকারী। আমাদের দেশে এখনো এর প্রচলন খুব বেশী না হলেও, কিছু ওয়েবসাইট অনলাইনে এই ধরনের ক্লাস নিয়ে থাকে বা ডিভিডি বিক্রি করে। প্রেগন্যান্সি রিলেটেড ব্যাপারগুলো সবাই সময়ে সব জানতে পারে। কিন্তু যে কোন জিনিস ঠেকে শেখার চাইতে, আগে থেকে জেনে রাখা সবসময় আপনাকে সুবিধাজনক জায়গায় রাখবে।
আগে থেকে নেওয়া প্রস্তুতি অনেক ব্যাপারই সহজ করে। ডাক্তার সব কিছু ধরে ধরে বলে দিবে, এমন মনে করার কোন কারন নেই। নিজে নেট থেকে ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখুন, প্রেগন্যান্সি রিলেটেড বই/ ম্যাগাজিন পড়ুন, অভিজ্ঞ লোকজনের পরামর্শ নিন। প্রেগন্যান্সির প্রস্তুতি যে কেবল মেয়েরাই নিবে, ছেলেদের কিছু করার নেই, এটা চিন্তা করা ভুল। কারন জেনেটিক ম্যাটারিয়ালের অর্ধেক কিন্তু বাবার কাছ থেকে আসে। কাজেই ভালো ডায়েট, হেলদি লাইফস্টাইল এগুলো ছেলেদের বেলায়ও প্রযোজ্য। প্রয়োজনে মেডিকেল টেষ্ট করিয়ে নেওয়া, যাতে কোন অসুস্থতা থাকলে আগে থেকেই ধরা পড়ে। দুইজনের প্রস্তুতিই পারে একটা সুস্থ প্রেগন্যান্সির জন্য আবহ তৈরী করতে।