বুলিং বরাবরই কমন ঘটনা। এখনকার সময়ে বুলিং থেকে সুইসাইডের ইন্সিডেন্ট খুব শোনা যাচ্ছে। কোন না কোন (শারীরিক, মানসিক) দিক দিয়ে দূর্বলের উপর সবলের অত্যাচার সবসময়ই ছিল। এখন এগুলো দিন দিন বাড়ছে। দেখতে কেমন, গায়ের রং কেমন, লম্বা-খাটো, মোটা-চিকন, ধর্মীয় পরিচয় বহন- অনেক অনেক কারনে বাচ্চারা বুলিং এর স্বীকার হতে পারে।
আমার নিজের লাইফে যে কত ভাবে কত সময় বুলি হয়েছি, তার ইয়ত্ত্বা নাই। জীবনে প্রথম যেদিন স্কুলে গেলাম, কিন্ডারগার্টেন, টিফিন টাইমে টিফিন বক্স কোলের উপর রেখে মাথা নিচু করে খাচ্ছিলাম (শাইনেসের জন্য)। দুইটা বাচ্চা দূর থেকে “দেখ দেখ, চুরি করে টিফিন খায়” বলে হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের উপর গড়িয়ে পড়ছিল। কতই বা বয়স তখন আমার, তাদের এই ছোট্ট কথা আমার কানে সীসা ঢেলে দিয়েছিলো। এত এত বছর পর এখনো যখন মনে করি, কি যে কষ্ট লাগে ওই বয়সী আমার জন্য! বুলিং এর সাইকোলজিক্যাল এফেক্ট এতটাই ভয়াবহ হয়। ক্লাস ওয়ান থেকে ফোর প্রায় রেগুলারলি বুলি হয়েছি। গরমে খুব ঘামাচি হতো কপালে, গালে। “ওর মুখে ঘামাচি, তাই খেলায় নিবো না ওকে।” খুব খেলো শোনাচ্ছে কথাগুলো? কিন্তু এইগুলাতেই ভয়াবহ কষ্ট পেতাম। একাএকা কেঁদেছি কত সময়! হাই স্কুলে উঠে আবার। ইউনিভার্সিটি উঠে আবার। কাজের জায়গায় যেয়ে আবার। আবার। যারা সে সময়গুলিতে বুলি করেছে, তারা কি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পেরেছে কি অজস্র ক্ষত তৈরি করে গেছে আমার ভেতরে! ওরা ভুলে গেছে হয়ত, আমি ভুলি নি। সব, সবকিছু ঠিকঠাক মনে আছে।
আমরা ওগুলো ভুলে যাই না সচরাচর। মনের খুব গভীরে ঢুকে পড়ে না চাইলেই। অনেক কিছু কত মাল্টি-ডাইমেনশনাল ওয়ে তে যে আমাদের মনে প্রভাব ফেলে, এরকম ঘটনা থেকে বোঝা যায়। আমি কখনই মনের দিক থেকে তেমন শক্ত পোক্ত ছিলাম না খুব একটা। বৈষয়িক বুদ্ধি তো কম বরাবরই। সহজেই মন খারাপ করতাম। কিন্তু ওই জায়গাগুলোতে আল্লাহ্ বাঁচিয়েছে আমাকে, বারবার উঠে দাঁড়িয়েছি। সুইসাইডাল চিন্তা আসে নি কখনো। কিন্তু এখনকার সময়ে বাচ্চারা অল্পতে ভেঙ্গে পড়ছে। মাথা সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না অনেকেই। আমাদের যাদের লাইফে এই ধরনের বুলি হওয়ার ঘটনা নাই, তারা সহজে আঁচ করতে পারবো না, কত কষ্ট থেকে বাচ্চাগুলো জীবন শেষ করে দিচ্ছে।
আপনি হয়ত বুলিং এর স্বীকার হোন নি, আপনার বাচ্চা হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? অনেক বুলি বাচ্চাকে দেখেছি, বাবা-মা সাপোর্ট করেন। বাচ্চারা দুষ্টামি করবে স্বাভাবিক, কিন্তু তারও একটা লিমিট আছে। অন্যের বাচ্চাকে শারীরিক দূরে থাক, মানসিকভাবে আঘাত করছে, এটা হতে দিবেন কেন? আপনার বাচ্চা বুলি না তো ঘরে বাইরে? দুষ্টামি করে আজেবাজে নিকনেম দেয়া, নেইম কলিং, ব্যাকবাইটিং যখনি বাচ্চার মধ্যে এইগুলা দেখবেন, সতর্ক হোন। প্যারেন্টিং এর স্টিয়ারিং হুইল ঠিক পথে নিতে হবে, তারই সতর্ক বার্তা এসব। তা না করে যখন ভিক্টিমের প্যারেন্টের অভিযোগ ভাঙ্গার চেষ্টা করবেন, “আমার বাচ্চা খারাপ হতে পারেই না”, তখন আসলেই নিজের পায়ে কুড়াল নিজেই মারলেন।
আমাদের দূর্বল বাচ্চাগুলোকে শেখানোর আছে অনেক কিছু। আমাদের শরীরের গড়ন যেরকমই হোক, যার উপর আমাদের হাত নেই (ল্ম্বা-খাটো, ফর্সা-কালো) আল্লাহ্ই বেষ্ট ওয়েতে (ফি আহসানি তাকওয়িম) আমাদের বানিয়েছেন। আমরা তাতেই সন্তুষ্ট থাকি। যদি মনে কষ্ট থেকে থাকে, সবর করতে শেখাই আল্লাহ্র সিদ্ধান্তের উপরে। বাচ্চাগুলাকে কনফিডেন্ট করে গড়ে তুলি। ভালো-খারাপ সময় যতই আসুক, উঠে দাঁড়াতে শেখাই। দরকারে হাত ধরে টেনে তুলি। শেখাই, হিজাবের জন্য তুমি অন্য দশজনের চাইতে আলাদা হতে পারো, দিনশেষে তুমিই উইনার। বাচ্চাদের জানাই যে আমাদের শরীরটা আমাদের কাছে আমানত। এপয়েন্টেড সময় এলে এমনিতেই তা মালিকের কাছে ফিরে যাবে। এই আমানত আমরা খিয়ানত করতে পারি না। বাচ্চাদের কথাগুলো একটু মনোযোগ দিয়ে শুনি। হোক যত সামান্য কথাই, তাচ্ছিল্য না করি। যখনি দেখবো আমাকে দিয়ে হচ্ছে না, প্রয়োজনে প্রফেশনাল হেল্প নেই। বাচ্চাদেরও এংজায়েটি হয়, ডিপ্রেশন হয়। একটু বোঝার চেষ্টা করি। স্কুলে যাওয়ার বয়সের আগেই বুলিং সম্পর্কে ধারনা দেই। সে নিজে যাতে বুলিং এর স্বীকার না হয়, আবার অন্যকে বুলি না করে।
বাচ্চার সাথে সাথে নিজেদের শোধরাতে হবে। আমরা বড়রা এডাল্ট বুলিং করছি না তো? ভাই-বোন, আত্মীয়- স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা আমাদের থেকে সেইফ তো? ভুল করে ফেললে শোধরানোর চেষ্টা করছি তো? অনেক ক্ষেত্রেই এক সময় বুলি হওয়া মানুষ বড় বয়সে এসে নিজের অজান্তেই আরেক বুলিতে পরিণত হয়। এই চেইন রিয়েকশন থেকে নিজেদের বাঁচাই, বাচ্চাদের বাঁচানোর চেষ্টা করি।
“ও বিশ্বাসীরা, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই আগুন থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ আর পাথর” (তাহরীম:৬)