এক বাসায় দাওয়াত। বাবা-মায়েরা গল্পগুজবে ব্যস্ত। বাসাভর্তি মানুষের সাথে গোটা দশেক বাচ্চাও গেষ্ট। বয়স ৬-১৫। কিন্তু বাচ্চাদের কোন হইচই নাই, গোলমাল নাই। সবাই কিন্তু একঘরে বসে। সবার হাতে নানা রকম গ্যাজেট- ফোন, ট্যাবলেট, আই-প্যাড। এক বাচ্চা কাঁদছে আর মাকে দুষছে, কেন তার মা আইপ্যাড আনতে ভুলে গেলো। এখন অন্যরা তাকে সুযোগ দিচ্ছে না। সেই মা আবার অন্য বাচ্চাদের কাছে কাঁকুতি মিনতি করছেন, যাতে তার বাচ্চাকে কিছুক্ষনের জন্য হলেও সুযোগ দেয়া হয়।
দৃশ্যপট-২
বাবা-মা দুইজনই বাড়ীতে ব্যস্ত যার যার কাজে। বাচ্চা দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা চালাচ্ছে অনেকক্ষন। এক পর্যায়ে ঘ্যানঘ্যান শুরু হলো। বাবা-মা দুইজনই বিরক্ত। ধরিয়ে দিলেন বাচ্চার হাতে ফোন। থাকুক কতক্ষন বাচ্চা ব্যস্ত। এই ফাঁকে উনারা দরকারী কাজ সেরে নেবেন। বাচ্চার শুরুটা হয়ত হয়েছিলো ইউটিউবের সিলেক্টেড কয়টা রাইমস দিয়ে। কিন্তু সে খুব দ্রুত আবিস্কার করে ফেললো ইচ্ছামতো অনেক ভিডিও চালানো যায়। এখন সে পুরাই এডিক্টেড। বাবা-মা তাকে সময় দিক বা না দিক, ফোন হাতে না পেলে সারা বাড়ী মাথায় তোলে। বাবা-মাও খুশী। এটলিস্ট সে তো নিজের মতো থাকছে, বিরক্ত করছে না। একদিন আচমকা খেয়াল করলেন, বাচ্চার নাম ধরে ডাকছেন তারা, ডেকেই যাচ্ছেন। কিন্তু বাচ্চা ফিরেও তাকাচ্ছে না। ফোন হাতে সে এতই বুঁদ হয়ে আছে, অন্য কিছু আর তার কানে ঢোকার লক্ষনই নেই।
দৃশ্যপট-৩
রাত বাজে ১২ টা। বাচ্চার ঘুমের নামগন্ধ নেই। সারা বিকাল, সন্ধা অবধি ঘুমিয়ে, এখন বাচ্চা একদম চাঙ্গা। জেগে থেকে বিরক্ত করছে খুব। টিভি ছেড়ে দেয়া হলো। গানের তালে তালে বাচ্চা নাচা শুরু করেছে। টিভি থেকে নাচের মুদ্রা তার ভালোই রপ্ত হয়েছে। বাবা-মা তাই ভিডিও করছেন, আর সোশাল মিডিয়াতে স্ট্যাটাস দিচ্ছেনঃ “রাত ১ টা, উনার চোখে ঘুম নাই। কি যে করি!“
দৃশ্যপট-৪
বাচ্চা খাওয়া নিয়ে ভীষন জ্বালায়। যতভাবে যত মজার খাবারই রান্না করে দেন না কেন, বাচ্চা কিছুতেই খেতে চায় না। বাচ্চাকে খাওয়ানোর খুব সহজ উপায় হলো, তাকে অন্যদিকে ব্যস্ত রাখা। বাবা-মা স্মার্টফোন কিংবা আইপ্যাডে বাচ্চাদের কার্টুন ছেড়ে দেন, রাইমস শুনতে থাকে বাচ্চা, আর অন্যদিকে চামচের পর চামচ খাবার ঢালতে থাকেন বাচ্চার মুখে। বাচ্চার যেহেতু খাবারের দিকে মনোযোগ নাই, কোনদিক দিয়ে খাবার শেষ হয়ে যাচ্ছে, তার কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। বাচ্চাও খুশী, বাবা-মাও খুশী।
উপরের দৃশ্যপটগুলো কি খুব অচেনা ঠেকছে? আমরা এমন এক সময়ের বাসিন্দা, যখন টিভি, ফোন, ট্যাবলেট, আইপ্যাড- এইসব ইলেকট্রিক গ্যাজেটগুলো আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গী। সব বাসাতেই এর কোনো না কোনোটা আছেই। বাসার ক্ষুদে সদস্যেরও নাগালের মধ্যে সবকিছু। এখনকার সময়ের ব্যস্ত বাবা-মায়ের সন্তানরাও তাই ব্যস্ত। এতটাই ব্যস্ত, তাদের কাছে এখন ফ্যামিলি টাইম কাটানোর চাইতেও গ্যাজেটে ব্যস্ত থাকা বেশী গুরুত্ব পায়। বাবা-মায়েরা ভাবছেন, বাচ্চা তো অনেক কিছু শিখছে ছোট বয়স থেকেই। বাচ্চা গড়গড় করে রাইমস বলতে পারে, গুনতে পারে, কালারের নাম জানে- এত কিছু যেখান থেকে শিখছে, সেটা তো আর ভাল বৈ খারাপ নয়। তার সাথে বোনাস হিসেবে বাচ্চা পাচ্ছে এডিকশন। এখনকার সময়ে একটা সাইন্টিফিক রিসার্চে দেখা গেছে, ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের প্রতি বাচ্চাদের আকর্ষন তাদের মস্তিস্কের উপর সেভাবে প্রভাব ফেলে, যেভাবে কোকেইন সেবনকারীর মাদকের প্রতি আকর্ষনে তাদের ব্রেইন সেল এক্টিভেটেড হয়।
এখনকার সময়ে, বয়সে ছোট বাচ্চারা দিনের একটা বড় অংশ কাটায় টিভির সামনে, ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে, কিংবা বাবা-মায়ের ফোনে এটা সেটা দেখে। এই ছোট বাচ্চাগুলোই যখন স্কুল শুরু করে, তখন দেখা দেয় নানারকম এটেশন ডেফিসিট ডিসওর্ডার, যাতে বাচ্চা কিছুতেই মনোযোগ বসাতে পারে না। না পড়াশোনায়, না তার সামাজিক সম্পর্কগুলোতে। বাচ্চারা স্ক্রিনজুড়ে রঙ্গিন ছবি, শব্দ, মিউজিক এগুলোতে এতবেশী আকর্ষিত হয় যে বাইরের সত্যিকারের জগত তার কাছে একঘেঁয়ে লাগতে থাকে। বাইরে দৌড়ানো কিংবা অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলার চেয়ে, সে বরং কার্টুন দেখা কিংবা গেইমস খেলাতেই মজা খুঁজে পায়।
কতটা সময় বাচ্চা গ্যাজেটের পেছনে কাটাবে?
বাচ্চাকে যদি ইলেক্ট্রিক গ্যাজেট মুক্ত রাখতে পারেন, সেটাই সবথেকে ভালো। অনেক কিছুই যেগুলো আপনি ভাবছেন, বাচ্চা ওয়েব থেকে শিখছে, সেগুলো সত্যিকারের জীবন থেকেও শেখা সম্ভব। ০-২ বছর বয়সী বাচ্চাদের জন্য সবচাইতে ভালো হলো “জিরো স্ক্রিন টাইম”। জ্বি, আপনি ঠিকই শুনছেন। ফোন, ট্যাবলেট কোন কিছুই না। তারপরও যদি একান্তুই বাচ্চাকে গ্যাজেট দিতে চান, তাহলে আমেরিকান একাডেমী অফ পেডিয়াট্রিকসের গাইডলাইন ফলো করতে পারেনঃ
১৮ মাসের কম বয়সী বাচ্চাদের স্ক্রিনযুক্ত যে কোন মিডিয়া থেকে দূরে রাখুন। বড়জোড় সে বাবা-মায়ের সাথে স্কাইপে দূরে থাকা আত্মীয়দের সাথে কথা বলতে পারে। এরকম ভিডিও চ্যাট ছাড়া আর কিছু এলাউ করবেন না।
১৮-২৪ মাস বয়সী বাচ্চা, যাদেরকে বাবা-মা ডিজিটাল মিডিয়ার সাথে পরিচয় করাবেন ভাবছেন, তারা বাচ্চার বয়স উপযোগী, হাই কোয়ালিটির ভিডিও প্রোগ্রাম বেছে নিন। এবং বাচ্চার সাথে বসে দেখেন, তাদেরকে বোঝান আসলে তারা কি দেখছে।
২-৫ বছর বয়সী বাচ্চাদের দিনে ১ ঘন্টার বেশী স্ক্রিন টাইম এলাউ করবেন না। তবে সে যাই দেখুক, সাথে বসে দেখেন এবং তাকে ব্যাখ্যা করেন, সেখানে কি হচ্ছে।
৬ কিংবা তার থেকে বেশী বয়সী বাচ্চাদের মিডিয়া ব্যবহারের জন্য অবশ্যই সময় বেঁধে দেবেন। কোন ধরনের মিডিয়া তারা ব্যবহার করবে, আপনিই ঠিক করবেন। এতে তার খাওয়া, ঘুম, স্বাভাবিক আচরনের যাতে কোন ব্যাঘাত না ঘটে, অবশ্যই খেয়াল রাখবেন।
খাওয়ার সময়, পরিবারের একসাথে সময় কাটানোর সময়গুলো যাতে গ্যাজেটফ্রি থাকে, সেটা নিশ্চিত করুন। শোবার ঘরে গ্যাজেট রাখা যাবে না।
বাচ্চাকে ডিজিটাল মিডিয়া থেকে দূরে রাখতে হলে, তাকে অন্য বিকল্প কিছু দিতে হবে। তা না করে, কেবল টিভি বা ফোন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে লাভ নেই। যেসব বাচ্চাদের এর মধ্যেই গ্যাজেটের প্রতি আকর্ষন জন্মে গেছে, তাদের গ্যাজেটপ্রীতি দূর করার জন্য এই টিপসগুলো ট্রাই করতে পারেনঃ
বাচ্চাকে সময় দিন। যেকোন বয়সী বাচ্চা অন্য যে কোন কিছুর চাইতে বাবা-মায়ের সংগ কামনা করে। বাচ্চার সাথে খেলুন, তাকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে যান, বাসায় বই পড়ে শোনান, গল্প শোনান। মোটকথা যেভাবেই পারেন বাচ্চার সাথে কোয়ালিটি টাইম কাটান।
গ্যাজেটপ্রীতি দূরকরনে, বাবা-মা একসাথে টিম হিসেবে কাজ করুন। দুইজনকেই একমত হতে হবে, বাচ্চার উপর গ্যাজেটের নেতিবাচক প্রভাব দূরকরন প্রসঙ্গে। বাচ্চারা জানে কার কাছ থেকে কিভাবে সুবিধা আদায় করতে হয়। কাজেই বাবা-মা মধ্যে যদি কোন কারনে মতপার্থক্য হয়, বাচ্চার সামনে প্রকাশ করবেন না।
খেয়াল রাখুন বাচ্চা কি দেখছে। টিভি প্রোগ্রাম আপনি বেছে দিন তার বয়স অনুযায়ী। বাচ্চাকে নিয়ে কখনোই তার বয়সের অনুপযোগী কোন অনুষ্ঠান দেখবেন না (বড়দের সিনেমা, নাটক, সিরিয়াল)। ইলেক্ট্রিক মিডিয়াগুলো রাখুন বাসার সবার জন্য কমন জায়গায়। ডেস্কটপ, ল্যাপটপ রাখুন বাসার কমন জায়গায় (যেমন ডাইনিং টেবিলের উপরে) যেখান থেকে সবার নজরে যায়, কি দেখা হচ্ছে।
পরিবারের সবার জন্য নিয়ম কানুন কঠোর রাখুন। সময় নির্দিষ্ট করে দিন। প্রাত্যহিক কাজ যেমন পড়াশুনা, হোমওয়ার্কের শেষে বাচ্চা কিছুসময় মিডিয়া ইউজ করতে পারবে, তার আগে নয়। বাড়ীর নির্দিষ্ট সময় রাখুন গ্যাজেটমুক্ত। যেমন খাওয়ার সময় কেউ ফোন হাতে নিতে পারবে না। বাসায় বাইরে সবাই একসাথে বেড়াতে গেলে, দরকারী ফোন ছাড়া, কোন গ্যাজেট সাথে যাবে না।
বাচ্চাদের দৈনন্দিন জীবনে বইয়ের প্রতি আকর্ষন বাড়ান। একটু কষ্ট করে হলেও বয়স উপযোগী বই কিনে দেন। দরকারে বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে তাদের বড় হয়ে যাওয়া বাচ্চাদের পুরনো বই সংগ্রহ করে নিন। বইয়ের জন্য কোন নির্দিষ্ট বয়স নেই। ০ বছর থেকে বাচ্চাদের বই পাওয়া যায়। কাপড়ের তৈরী বই, যে একদম ছোট বাচ্চাদের জন্য তৈরী, রঙ্গিন, শব্দওয়ালা- তাই কিনে দিন। প্রথম প্রথম বাচ্চা বই নিয়ে খেলবে। খেলতে দিন। আরেকটু বড় বাচ্চাদের জন্য মোটা কাগজের তৈরী বোর্ডবুক, যেগুলো বাচ্চারা কামড়ালেও সহজে নষ্ট হবে না, সহজে ছিঁড়ে না। ঝলমলে রঙ্গিন ছবিওয়ালা বই কিনে দিন। নিজে পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। বাচ্চাকে তার বই পড়ে শোনান।
বাচ্চার সাথে খেলুন। সম্ভব হলে তাকে বাসার বাইরে পার্কে নিয়ে যান। তার সাথে দৌড়ান। বাসায় বসে তার খেলনা দিয়ে, সাথে খেলুন। বয়স উপযোগী পাজল কিনে দেন। একসাথে বসে মেলান। একদম ছোট বাচ্চাদের জন্য কাঠের, প্লাস্টিকের ৪-৫ টুকরার পাজল পাওয়া যায়। আর বড় বাচ্চাদের জন্য থিমবিশিষ্ট পাজল। পাজলগুলো বাচ্চার বুদ্ধিমত্তা বিকাশে সহায়ক। ক্রাফটস বানান। নানা রকম এক্টিভিটিসে বাচ্চাকে ব্যস্ত রাখুন।
বাচ্চাকে গ্যাজেটের বিকল্প দিন। একসাথে সময় কাটান। রান্না করেন তাকে নিয়ে। ছোট বাচ্চাদের হাতে আলু-পেঁয়াজ দিন খেলতে। আরেকটু বড় হলে তাকে নিয়োজিত করুন রান্নার কাজে। যেমনঃ সে আটা মলতে পারে, ময়দা মাখাতে পারে, সবজি ছোট টুকরা করতে পারে। একসাথে বানালেন কোন একটা ডিশ। বাচ্চাকে বাইরে নিয়ে যায় সাঁতার শেখাতে, সাইকেল চালানো শেখাতে। এমন স্কিল শেখান, যা তার জীবনে কাজে দেবে। বাগান করতে পারেন একসাথে, সে বাসার বাইরে হোক, আর ছাদে কিংবা ব্যালকনিতে হোক। তাকে নিয়ে চারা লাগান, গাছের যত্ন নিন। সে দেখুক কিভাবে ধীরে ধীরে চারাগাছ বড় হয়। ফুল ফোটে কিংবা ফল হয়।
বাচ্চার জন্য যা নিয়ম রাখবেন, নিজের জন্যও তা প্রয়োগ করুন। নিজেও গ্যাজেটের ব্যবহার কমিয়ে দিন। বাচ্চাকে ব্যবহার করতে না দিয়ে, আপনি নিজেই যদি ঘনঘন মেইল চেক করতে থাকেন ফোনে বা বাইরে বেড়াতে যেয়ে ফোনে কথা বলতে থাকেন বা টেক্সট করতে থাকেন, তাহলে সেটা কিন্তু বাচ্চার জন্য ভালো উদাহরন সেট করা হলো না। নিজে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন, বাচ্চাকেও উৎসাহিত করুন।
বয়সে বড় বাচ্চাদের টিভি, সোশাল মিডিয়ার ভালো-মন্দ সম্পর্কে বলুন। নিজের ছবি, ব্যক্তিগত তথ্য গোপনীয় রাখার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরুন। বাচ্চার সাথে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক বজায় রাখুন। যাতে বাচ্চা যেকোন প্রয়োজনে, বিপদে-আপদে আপনাকে পাশে পায়। যেকোন গ্যাজেট বাচ্চার হাতে দেয়ার আগে, তার ব্যবহার পদ্ধতি, নিরাপত্তা সম্পর্কে ওয়াকাবিহল হন।
মনে রাখবেন, বাচ্চাকে নিত্য নতুন গ্যাজেট কিনে দেয়ার মধ্যে কোন স্মার্টনেস নেই। বরং দরকারি গ্যাজেটের সীমিত ব্যবহারে নিজে ও বাচ্চাকে অভ্যস্থ করাই স্মার্ট প্যরেন্টিং।